“দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ”-এ চিন্তাধারা হতেই সমবায়ের জন্ম, সমবায় সংগঠন বা সমিতি হলো কতিপয় ব্যক্তির একটি স্বেচ্ছামূলক সংগঠন। এধরনের সংগঠনে সদস্যরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়ে থাকে। এটি এমন এক ধরনের ব্যবসায় সংগঠন যা মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সৃষ্টি না হয়ে সদস্যদের পারস্পরিক কল্যাণার্থে সৃষ্টি হয়। সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে সমাজে পুঁজিপতিদের শোষণ হতে অপেক্ষাকৃত দূর্বল শ্রেণির মানুষদের কল্যাণ সাধন করা হয় ।
এ অধ্যায় পাঠশেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকে সমবায় সংগঠনের ভাবনা দানা বাঁধলেও শিল্প বিল্পবের শুরুর পর এ চিন্তা বাস্তবরূপ লাভ করে । ১৭৫২ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বৃটেনে আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায় গঠিত হয় ১৮৪৪ সালে। এ সময়ে বৃটেনের রচডেল নামক স্থানের ২৮ জন তাঁতী মাত্র ২৮ পাউন্ড পুঁজি সহযোগে এ ধরনের ব্যবসায় গড়ে তোলে। এর পর সমবায় এক আন্দোলনে রূপ নেয় যার ঢেউ বাংলাদেশেও এসে লেগেছে। বাংলাদেশে সমবায় সমিতি বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুর্বল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণের জন্য সমবায়ের যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়নে সমষ্টিগতভাবে বহুসংখ্যক মানুষের সহযোগিতায় তা সহজেই করা সম্ভব হয়, এটাই সমবায়ের মূল কথা। অর্থাৎ মুনাফা অর্জন নয়-পারস্পারিক কল্যাণসাধনই এ সমবায়ের মূল লক্ষ্য।
সমবায় একটি আইন সৃষ্ট, অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যবসায় সংগঠন। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট পেশাজীবীরা উদ্দেশ্য অর্জনে উৎসাহ বা শক্তি পায়। এটি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি সংগঠন। বাংলাদেশে সমবায় আইন-২০০১ অনুসারে সমবায় সংগঠন গঠিত ও পরিচালিত হয়। নিম্নে সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করা হলো—
পরিশেষে বলা যায় যে, সমবায় সমিতি আইনের অধীন গঠিত, পরিচালিত, পৃথক সত্তা ও সীমিত দায় বিশিষ্ট একটি স্বেচ্ছা প্রণোদিত ব্যবসায় সংগঠন। এর সদস্যরা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণে পরিচালিত হয় যার মূল লক্ষ্য হলো এর সদস্যদের আর্থিক কল্যাণ নিশ্চিত করা।
নীতিমালা শব্দটির ইংরেজি শব্দ হলো Principles একে guidence for action বলা যায়। সমবায় সংগঠনও কিছু নীতি বা আদর্শ মেনে চলে। একটি ভিন্নধর্মী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে সমবায় সংগঠন সমাজের মধ্য ও নিবিত্ত, সম্পন্ন মানুষের নানান সীমাবদ্ধতা নিয়ে পারস্পারিক অর্থনৈতিক কল্যাণের লক্ষ্যে গঠিত ও পরিচালিত হয়। যেসব আদর্শ বা নীতিমালা মেনে সমবায় সমিতি পরিচালিত হয় সেগুলো নিম্নে বর্ণিত হল-
১। একতা (Unity): একতাই বল। সমাজের দরিদ্র ব্যক্তি একতাবদ্ধ হলে ধনীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনায়াসে দাঁড়াতে পারে। একতাই মূলত সমবায়ের সাফল্যের মূল স্তম্ভ।
২। সততা (Honesty): সমবায় সমিতিতে সততা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানে সততা বিরাজমান হলে সদস্যদের মনে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করতে হলে সততা একান্ত অপরিহার্য।
৩। স্বেচ্ছাকৃত মিলন (Voluntary Association): সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে সর্বাধিক ব্যক্তি স্বাধীনতা দেয়া হয়। কোনো প্রকার হুমকি বা প্ররোচনা ছাড়া তারা সমবায়ের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় মিলিত হতে পারে ।
৪। সহযোগিতা (Co-operation): সহযোগিতা সমবায়ের একটি অন্যতম নীতি। পারস্পরিক কল্যাণের লক্ষ্যে সমবায়ের সদস্যদের মধ্যে ‘দশে মিলে করি কাজ' অথবা ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' এরূপ মনোভাব থাকা প্রয়োজন। কেননা একমাত্র সহযোগিতাই সাফল্য লাভের অন্যতম চাবিকাঠি।
৫। গণতন্ত্র (Democracy): সমবায় সমিতিতে সর্বদাই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসৃত হয়। এ সমিতির ‘পরিচালক কমিটি’ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। সিদ্ধান্তও ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সদস্য স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।
৬। সমঝোতা (Understanding): সমবায়ের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সমঝোতা অপরিহার্য। কারণ ত্যাগের মনোভাব ছাড়া সমবায় সমিতি টিকে থাকতে পারে না। আর এজন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সমঝোতা ।
৭। সাম্য (Equality): সমবায় সমিতি সাম্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত। এর সদস্যরা সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পারিবারিকভাবে যাই হোক না কেন সমবায়ের সদস্য হিসেবে তারা সবাই সমান সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। নিজেদের মধ্যে এধরনের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সমবায় সাফল্য লাভ করতে পারে না ।
৮। সেবা (Service): সমবায়ের মূলকথা হলো ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' । একে অপরের সহযোগিতার ভিত্তিতে এ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বলা যায়, প্রত্যেকের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকা আবশ্যক ।
৯। নৈকট্য (Proximity): সমবায় সমমনা ব্যক্তিবর্গের সংগঠন। তাই এর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নৈকট্যের বিষয়টি বিবেচনা করতে হয় । সদস্যরা সমমনা না হলে প্রতিষ্ঠান চালাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হতে হয় ।
১০। সম-ভোটাধিকার (Equal right of votes): সম-ভোটাধিকার সমবায় সমিতির অন্যতম মূলনীতি । প্রতিষ্ঠানে যে যত বিনিয়োগ করুক না কেন সবার ভোটাধিকার সমান। এক্ষেত্রে সকলে একটি করে ভোট প্রদান করে কার্যকরী কমিটি নির্বাচন করে থাকেন ।
১১। নিরপেক্ষতা (Secularism): সমবায়ের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শের নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। ফলে ধর্ম ও রাজনৈতিক মত নির্বিশেষে সকলেই এর সদস্য হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সমবায়ে সফলতা অর্জন করতে হলে উক্ত মূলনীতি বা আদর্শসমূহ যথাযথভাবে অনুসরণ করা উচিত। এর অধিকাংশই একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত কার্যক্ষেত্রে এর সবগুলো সমানভাবে অনুসরণ করতে হয়। যে সমবায় উক্ত আদর্শসমূহ যত বেশি অনুসরণ করতে পারে বাস্তবে তার পক্ষেই তত সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।
সমবায় সমিতি একটা আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান। একাধিক ব্যক্তি নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশের সমবায় সমিতিসমূহ “সমবায় সমিতি ২০০১” এবং “সমবায় বিধি ২০০৪” বলে গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সমমনা ও সমস্বার্থবিশিষ্ট কমপক্ষে ১০ জন সদস্যকে সমিতি গঠনের জন্য সম্মত হতে হয় বয়স যাদের ১৮ বছর বা তার ঊর্ধ্বে।
নিম্নে এরূপ প্রতিষ্ঠান গঠনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপসমূহ আলোচনা করা হলো :
সমবায় সমিতি গঠনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণকারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়। একই এলাকার সমমনা, সমপেশা ও সমশ্রেণির কমপক্ষে ২০ (বিশ) জন উদ্যোক্তা সমিতি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। উদ্যোক্তাদেরকে অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন অর্থাৎ চুক্তি সম্পাদনে যোগ্য হতে হবে। উদ্যোক্তারা প্রথমেই নিজেদের মধ্য হতে কমপক্ষে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে। ব্যবস্থাপনা কমিটির পদগুলো নিম্নরূপ—
i.চেয়ারম্যান -১ জন
ii. ভাইস চেয়ারম্যান- ১ জন
iii. সেক্রেটারি - ১ জন
iv. সাধারণ সদস্য -৩ জন
(তন্মধ্যে ১ জন কোষাধ্যক্ষ হতে পারে, সেক্ষেত্রে সাধারণ সদস্য হবে ২ জন)
এরূপ কমিটি সমবায় সমিতির নিবন্ধনসহ গঠন সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে। কমিটির প্রথম দায়িত্ব হলো একটি খসড়া উপবিধি (By-laws) তৈরি করা। উপবিধিতে প্রধানত নিােক্ত বিষয়ের উল্লেখ থাকে-
ক. . সমবায় সমিতির নাম (সসীম দায়সম্পন্ন সমিতির নামের শেষে সীমিত বা Ltd. শব্দের উল্লেখ থাকবে);
খ. ঠিকানা ও কার্য এলাকা;
গ. উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম;
ঘ. উদ্যোক্তাদের নাম, ঠিকানা ও পদবি ;
ঙ. সদস্য অন্তর্ভুক্তি ও অব্যাহতির নিয়ম;
চ. মূলধনের পরিমাণ ও শ্রেণিবিভাগ;
ছ. শেয়ার মূল্য, শ্রেণিবিভাগ ও মোট শেয়ার সংখ্যা;
জ শেয়ার বিক্রয় পদ্ধতিঃ
ঝ. সমিতি পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম-কানুন প্রভৃতি।
উদ্যোক্তারা ইচ্ছা করলে এধরনের উপবিধি প্রস্তুত না করেও সমবায় বিভাগ হতে ছাপানো উপবিধি সংগ্রহ করে উক্ত উপবিধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ পর্যায়ে প্রস্তাবিত সমিতির জন্য সীলমোহর প্রস্তুত করা হয় ।
এ পর্যায়ে সমবায় সমিতি নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হয় । যে এলাকায় সমিতি স্থাপন করতে ইচ্ছুক সে এলাকায় সরকার নিযুক্ত সমবায় সমিতি নিবন্ধকের অফিস হতে নিবন্ধন ফরম সংগ্রহ করা হয়। নিবন্ধন ফরম যথাযথভাবে পূরণ করে প্রয়োজনীয় দলিলপত্রাদি ও ফি সহ নিবন্ধকের নিকট জমা দেয়া হয় ।
আবেদন ফরমের সাথে নিম্নোক্ত দলিলপত্র জমা দিতে হয়—
ক. সমিতির সদস্যদের স্বাক্ষরযুক্ত নাম ও ঠিকানা । এক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ (বিশ) জন প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্যের নাম ও তারিখসহ স্বাক্ষর থাকতে হয় ।
খ. উদ্যোক্তাদের স্বাক্ষরসহ উপবিধি-২ কপি
গ. সমিতির সিলমোহরের নমুনা-১ টি
ঘ. আবেদন ফরমটি আইনসম্মতভাবে পূরণ করা হয়েছে এবং এতে উল্লিখিত তথ্যসমূহ সঠিক-এমর্মে সেক্রেটারি ও উদ্যোক্তাদের ঘোষণাপত্র ১ কপি ৷
উল্লেখিত কাগজপত্র ও নির্ধারিত ফি পাওয়ার পর নিবন্ধক কাগজপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করেন এবং এ বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে আবেদনপত্র প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে তা মঞ্জুর করে নিবন্ধন পত্র ইস্যু করেন। ৬০ দিনের মধ্যে নিবন্ধনপত্র ইস্যু না করলে এবং আবেদন পত্র গৃহীত হলে নিবন্ধক নিবন্ধন সনদ হিসেবে নিবন্ধনপত্র ইস্যু করেন। এ পর্যায়ে নিবন্ধক সমিতির উপবিধির ৩ কপির প্রত্যেক পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর ও সীলযুক্ত করে ১ কপি নিবন্ধন অফিসে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাখেন এবং ২ কপি উদ্যোক্তাদের ফেরত দেন। উল্লেখ্য, আবেদনপত্র প্রাপ্তির পর নিবন্ধক যদি দেখেন কোনো তথ্য বা কাগজপত্রের ঘাটতি রয়েছে তবে সেগুলো অনধিক ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ে বা তদন্ত করে নিবন্ধনের উপযুক্ততা দেখা হয় । এভাবেই সমিতির নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে।
নিবন্ধনের মাধ্যমে সমবায় সমিতি আইনানুগ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং সমিতির নাম ও সীলমোহর ব্যবহার করে উদ্যোক্তাগণ ও কমিটি সমিতির স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে। এরপর সমিতির কর্মকাণ্ডে আর কোনো বাধা থাকে না ।
পরিশেষে বলতে পারি যে, সমবায় সংগঠন সুনির্ধারিত সমবায়ের গঠনের নিয়ম মেনে গঠিত ও পরিচালিত হয়। একটি নিবন্ধিত ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে সমবায় সংগঠনকে অবশ্যই এসব নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয় ।
সমবায় ‘একতাই বল’ বা ‘দশে মিলে করি কাজ'-এ জাতীয় নীতিতে বিশ্বাস করে সংগঠিত হয়, অর্থাৎ সমাজের স্বল্প আয় বিশিষ্ট সাধারণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণ ধর্মী যৌথ প্রচেষ্টার সংগঠন হচ্ছে সমবায় সংগঠন। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাবার লক্ষ্যে নানাধর্মী সমবায় সংগঠন গড়ে তুলতে পারে । এ কারণে সমাজে বিচিত্রধর্মী সমবায় সংগঠন দেখতে পাওয়া যায় ।
নিম্নে একটি চিত্রসহ বিভিন্ন প্রকার সমবায় সংগঠনের বর্ণনা দেয়া হলো-
১. উৎপাদক সমবায় সমিতি (Producers co-operative society)
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক ও উৎপাদকগণ বৃহদায়তন শিল্পগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের স্বল্প অর্থকে একত্রিত করে যে সমবায় গঠন করে তাকে উৎপাদক সমবায় সমিতি বলে। কোনো এলাকায় কতিপয় শ্রমিক একত্রে মিলে কোনো উৎপাদন শুরু করলে বা কতিপয় ব্যক্তি সমবায়ের ভিত্তিতে কোনোরূপ উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত হলে তা উৎপাদক সমবায় সমিতি নামে পরিচিত হবে। তাঁতিদের সমবায়, দুগ্ধ উৎপাদক সমবায়, কৃষক সমবায়, জেলে সমবায় ইত্যাদি এ জাতীয় সমবায় সমিতির উদাহরণ।
২. ভোক্তা সমবায় সমিতিConsumers Co-operative Society
যখন কোনো বিশেষ পণ্যের বা কতিপয় পণ্যের ভোক্তাগণ মধ্যস্থব্যবসায়ীর মুনাফার শিকার না হয়ে ন্যায্য মূল্যে জিনিস কিনতে চান তখন তাদের চাহিদা পূরণে যে সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় তাকে ভোক্তা সমবায় সমিতি বলে। এ সমবায় সমিতি উৎপাদনকারী, আমদানিকারক বা পাইকারের নিকট থেকে পাইকারি মূল্যে পণ্যসামগ্রী খরিদ করে সেসব পণ্য সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্যের নিকট ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করে থাকে। ভোক্তা সমবায় সমিতিকে বণ্টনকারী সমবায় সমিতি নামেও অভিহিত করা হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানের গেটে, বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানে, বড় হাউজিং কমপ্লেক্সের গেটে এর মালিকদের উদ্যোগে এধরনের সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হতে পারে।
১. ক্রয় সমবায় সমিতি (Purchasing co-operative society): বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ যদি সমবায় সমিতির মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সংগ্রহের জন্য ক্রয় সুবিধা গ্রহণ করে তবে তাকে ক্রয় সমবায় সমিতি বলে।
২. বিক্রয়/বিপণন সমবায় সমিতি (Marketing co-operative society): ক্ষুদ্র উৎপাদক, কৃষক ইত্যাদি শ্রেণীর লোকজন তাদের পণ্যদ্রব্য বিক্রি, গুদামজাতকরণ, পরিবহণ ইত্যাদি ব্যাপারে পাইকারি সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে যদি কোনো সমবায় সংগঠন করে তবে বিক্রয় সমবায় সমিতি বলে।
৩. আমদানি সমবায় সমিতি (Import co-operative society): ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণ তাদের নানাবিধ সুবিধা ও সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের নিমিত্তে যে সমবায় সমিতি গঠন করে তা আমদানি সমবায় সমিতি নামে পরিচিত।
৪. রপ্তানি সমবায় সমিতি (Export co-operative society): ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণ রপ্তানি বিষয়ে পাইকারি সুবিধা, সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ও সরকারের নিকট হতে দাবি আদায়ের নিমিত্তে যদি কোনো সমবায় সমিতি গঠন করে তাকে রপ্তানি সমবায় সমিতি বলা হবে ।
৫. বীমা সমবায় সমিতি (Insurance co-operative society): নিজেদের বীমা নিজেরা সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য কোনো জনগোষ্ঠী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করলে তাকে বীমা সমবায় সমিতি বলা হয় ।
৬. ব্যাংক সমবায় সমিতি (Bank co-operative society): ক্ষুদ্র আয়তনের ভিত্তিতে সদস্যদের নিকট হতে আমানত গ্রহণ ও তাদেরকে ঋণদানের জন্য যে সমবায় গড়ে ওঠে তাকে ব্যাংক সমবায় সমিতি বলা হয় ।
৭. ঋণদান সমবায় সমিতি (Credit co-operative society): মহাজন বা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের বদলে কম সুদে নিজেদের সঞ্চয় হতে ঋণ গ্রহণের জন্য যদি পেশাজীবীরা মিলিত হয়ে কোনো সমবায় গঠন করে তাকে ঋণদান সমবায় সমিতি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
৮. গৃহনির্মাণ সমবায় সমিতি (Housing co-operative society): যদি মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্ত লোকেরা নিজেদের গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে কোনো সমবায় গড়ে তোলে তবে তাকেই গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি বলা হয়।
৯. সমবায় আবাসিক এলাকা (Co-operative housing society): কোনো স্থানে আবাসিক প্লট খরিদের উদ্দেশ্যে যদি কোনো জনগোষ্ঠী একত্রিত হয় তবে তাকে সমবায় আবাসিক এলাকা বা আবাসিক এলাকাভিত্তিক সমবায় বলে ।
১০. বহুমুখী সমবায় সমিতি (Multi purpose co-operative society): যখন কোনো সমবায় সমিতি বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়িক কাজে লিপ্ত হয় তখন তাকে বহুমুখী সমিতি বলে । এরূপ সমবায় সমিতি ক্রয়, বিক্রয়, গৃহ নির্মাণ ঋণদান, ব্যাংকিং, বিমা-এ ধরনের বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে থাকে ।
১. প্রাথমিক সমবায় সমিতি (Primary co-operative society): প্রাথমিক সমবায় সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যা সর্বনি স্তর বা প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত হয়। সমবায় বলতে মূলত এ স্তরের সমবায়কেই বুঝানো হয় । গ্রামীণ সমবায় সমিতিসমূহ এর উদাহরণ ।
২. কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি (Central co-operative society): ন্যূনতম ১০টি প্রাথমিক সমবায় সমিতির সম্মিলিত রূপ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি । গ্রামীণ কৃষক সমবায় সমিতিসমূহ মিলে ইউনিয়ন বা থানা পর্যায়ে সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে এ জাতীয় সমিতি গঠিত হয়। এটি সমবায়ের দ্বিতীয় স্তর। এ সমিতিতে কোনো ব্যক্তি সদস্য হতে পারে না ।
৩. মিশ্র সমবায় সমিতি (Mixed co-operative society): এটি সমবায়ের তৃতীয় স্তর। ব্যক্তি সদস্যের পাশাপাশি প্রাথমিক সমবায় সমিতিগুলো এর সদস্য হয়ে থাকে। বিভাগীয় (বা প্রদেশ) পর্যায়ে সমবায় সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে এ ধরণের সমবায় সমিতি গঠন করে। এ সমবায় সমিতির জন্য ন্যূনতম ২০ জন সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে ১২টি প্রাথমিক সমবায় সমিতির সদস্য থাকতে হয়।
৪. জাতীয় সমবায় সমিতি (National co-opeative society) : এটি সর্বোচ্চ স্তরের (চতুর্থ স্তর) সমবায় সংগঠন। জাতীয় পর্যায়ে যে সমিতি গঠন করা হয় তাকেই জাতীয় সমবায় সমিতি বলে। ১০টি কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি মিলে জাতীয় সমবায় সমিতি গঠিত হয়।
১. অসীম-দায় সমবায় সমিতি (Unlimited co-operative society): অসীম দায় সমবায় সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যেখানে সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ার দ্বারা বা অন্য উপায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না । সমিতির দেনার জন্য এ জাতীয় সমিতির সদস্যরা এককভাবে এবং যৌথভাবে দায়ী থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের সমিতির প্রচলন দেখা যায় না।
২. সসীম দায় সমবায় সমিতি (Limited Co-operative society): সমবায় সমিতির সদস্যদের দায় যখন তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের আংশিক মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে তখন সসীম-দায় সমবায় সমিতি বলে। সদস্যদের সীমিত দায়কে বুঝাবার জন্য এরূপ সমিতির নামের শেষে ’লিমিটেড’ বা ‘Ltd’ শব্দ যোগ করা হয়। দেশের অধিকাংশ সমবায়ই এ শ্রেণিভুক্ত।
পরিশেষে বলা যায়, বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পূরণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতি কাজ করছে, স্বল্প সময়ের মানুষের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও টিকে থাকার জন্য ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন সমবায় সমিতি গড়ে উঠবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় ।
স্বল্পবিত্ত সম্পদ বা বিত্তহীন ব্যক্তিদের পক্ষে সীমিত সামর্থ্য ব্যবহার করে এককভাবে বড় কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। সমিতি গঠনের মাধ্যমে এরূপ সীমিত সামর্থ্যের মানুষ নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পারে। তাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ পারস্পারিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সমবায় সমিতি গঠন করে ।
নিম্নে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় সমিতির অবদান বর্ণনা করা হলো—
১. অর্থনৈতিক সুবিধা (Economic Advantages): সমবায় সংগঠন মূলত সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে নানাভাবে কাজ করে। যেমন- কৃষক বা কম আয়ের সদস্যদের আর্থিক সুবিধা প্রদান, পণ্য বা সেবা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বা বিভিন্ন প্রয়োজনে স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দান প্রভৃতি । ফলে সমিতির সদস্যরা মহাজনের দৌরাত্ম্য হতে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
২. সামাজিক সুবিধা (Social Advantages): সমবায় গঠনের মাধ্যমে বঞ্চিত জনগণ আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক সুবিধা ভোগ করে থাকে। সামাজিক সুবিধার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, গণতন্ত্রের চর্চা, অর্থনৈতিক শক্তির বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সদস্যদের মর্যাদা বৃদ্ধি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
৩. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন (Improving Standard of Living): সমবায় সমিতি সমাজের নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনদের সংগঠন। সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে সদস্যদের আয় বৃদ্ধি, ন্যায্য মূল্যে পণ্য প্রাপ্তি, ঋণ সহায়তা প্রাপ্তি কর্মসংস্থানের সুযোগ, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, যা তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্ৰত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।
৪. কম ব্যবস্থাপনা ব্যয় (Low Management Cost) : সদস্যদের স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের ফলে ব্যবস্থাপনা খরচ বহুলাংশে হ্রাস পায়। ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণকারীদের কোনো প্রকার বেতন-ভাতা প্রদান করতে হয় না। তারা সমিতি পরিচালনায় খুব আগ্রহের সাথেই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে ।
৫. বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুবিধা (Advantage of Large scale Business) : সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় সমবায় সমিতি অধিক সঞ্চয় সংগ্রহ ও পুঁজি গঠন করতে পারে। যা দিয়ে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের বিভিন্ন সুবিধা যেমন- বৃহদায়তন ক্রয়, উৎপাদন ও বিপণন সুবিধা পাওয়া যায়। এতে সমিতির আয় বৃদ্ধি পায় ।
৬. সেবার উদ্দেশ্য (Service Motive) : এরূপ সংগঠন মূলত সদস্যদের সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়, মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে নয়। সদস্যদেরকে বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা ও ন্যায্যমূল্যে পণ্য বা সেবা প্রদানের সুযোগ দেয়া হয়। সমিতির সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব কাজ করে।
৭. করের অব্যাহতি (Tax Relief): সমবায় সমিতি গঠনে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এরূপ সংগঠনের আয়ের ওপর কর ধার্য করা হয় না। ফলে সদস্যদের অধিক আর্থিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায় ।
৮. সরকারি সহায়তা (Government Help): দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সমবায় সংগঠনগুলো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। আর এ ভূমিকাকে আরো বেশি উৎসাহিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সমবায়ীদের বা সমিতিকে আর্থিক ও অনার্থিক বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হয় ।
৯. মনোবল উন্নয়ন (Moral Development): সমবায় সমিতি কতিপয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। যেমন-পারস্পরিক সহযোগিতা, আত্মসহযোগিতা, কঠোর পরিশ্রম, শিক্ষা, আত্মনির্ভরশীলতা, সঞ্চয় সংগ্রহ প্রভৃতি। এসব আদর্শ অনুশীলনের ফলে সদস্যদের মধ্যে যেকোনো কঠিন কাজ খুব সহজে সম্পন্ন করার মনোবল ও মানসিকতা তৈরি হয়।
পরিশেষে বলা যায়, উপরিউক্ত সুবিধার কারণে সমবায় সংগঠন সাধারণত বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ও আকর্ষণীয় সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মোটকথা, ব্যক্তিক, সামাজিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় সমিতির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ।
Bangladesh Academy for Rural Development” বা BARD পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালে কুমিল্লার কোটবাড়িতে প্রখ্যাত সমাজকর্মী অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খান এ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন ।
এ একাডেমির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পল্লী তথা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন। এ উদ্দেশ্যে একাডেমির গৃহীত পদক্ষেপ ও কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পরীক্ষামূলক প্রকল্প পরিচালনা, পল্লী উন্নয়নের উপর সেমিনার, আলোচনা ইত্যাদি। প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে এখানে প্রশিক্ষণ প্রার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ওয়ার্কশপ, ক্যান্টিন প্রভৃতি সর্বাধিক সুযোগ- সুবিধা রয়েছে। বার্ড-এর এ বহুমূখী অবদান ও কার্যকলাপের জন্য একে কুমিল্লা মডেল নামেও অভিহিত করা হয় । প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী অবদান অনস্বীকার্য।
তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ হিসেবেই বাংলাদেশ সবার কাছে পরিচিত। এদেশে নিবিত্ত সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বেশি। এদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বিশেষ করে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন গতি পেয়েছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখা যায়না ।
বাস্তবক্ষেত্রে এদেশে সমবায় আন্দোলনে যে সমস্যা লক্ষনীয় তা নিম্নে তুলে ধরা হলো—
১. সঠিক পরিকল্পনার অভাব (Lack of proper planning): বাংলাদেশে সমবায় সমিতির উন্নয়নে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। ফলে এদের অস্তিত্ব হয় স্বল্পমেয়াদি এবং বিকাশ হয় বাধাপ্রাপ্ত ।
২. প্রশিক্ষণের অভাব (Lack of training): সমবায়ের নির্বাহীগণের কোনোরূপ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ নেই বলে তারা অনেক সময় ভুল পথে পরিচালিত হয়।
৩. আমলাতান্ত্রিক মনোভাব (Bureaucratic attitude): এদেশে কেউ কোনো দ্বায়িত্ব ও ক্ষমতা পেলেই নিজেকে একজন অসাধারণ ব্যক্তি ভাবতে শুরু করেন। আর সমবায় সমিতি পরিচালনার জন্যে নিযুক্ত ব্যক্তিরাও আমলাতন্ত্রিক মনোভাব ধারণ করায় তারা সদস্যদের সেবার বদলে অনেক সময় অসুবিধা সৃষ্টি করেন। ফলে সমবায় সমিতি ভেঙ্গে যায়।
৪. স্বজন-প্রীতি (Nepotism): সমিতির পরিচালকদের স্বজন-প্রীতি বাংলাদেশের সমবায়গুলোর বিকাশের পথে অন্তরায় । বিশেষ করে ঋণদান সমবায় সমিতিগুলোর ঋণদানের ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দেয় বেশি ।
৫. শিক্ষার অভাব (Lack of education): বাংলাদেশে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই অধিক। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা না থাকায় তারা সমবায় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমবায় প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য ।
৬. অসম প্রতিযোগিতা (Un-equal competition): ক্ষুদ্রায়তন প্রকৃতির সংগঠন হওয়ায় সমিতিকে মধ্যম ও বৃহদায়তন সংগঠনের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
৭. সততা ও নিষ্ঠার অভাব (Lack of honesty and sincerity): সমবায়ের মতো যৌথ প্রচেষ্টার সফলতা অনেকটাই সততা ও নিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে এ দুটোরই বিসর্জন দিতে বসেছে। ফলে সমবায় সমিতির উদ্দেশ্যও আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
৮. মূলধনের স্বল্পতা (Defeciency of Capital) : সমবায় দরিদ্রদের সংগঠন। তাদের প্রদত্ত স্বল্প পরিমাণ চাঁদা সমিতির জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় মূলধন সৃষ্টি করে না ।
৯. সরকারের সহযোগিতা (Co-operation of govt): সমবায়ের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উন্নয়ন করা সম্ভব । কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এক্ষেত্রে কম ।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সমবায় সমিতিকে এগিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও উপরিউক্ত সমস্যার কারণে তা যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করতে পারছে না। তাই এসব সমস্যা দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবারই মহানুভবতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন ।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য, অনগ্রসরতা ও অভাব-অনটন থেকে নিম্নবিত্তসম্পন্ন ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করে উন্নয়নের নতুন পথ দেখাতে হলে সমবায় আন্দোলন যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ লক্ষ্যে অনেক পূর্ব হতেই এদেশে সমবায় আন্দোলন শুরু হলেও কিছু সমস্যার কারণে তা সফলতার মুখ দেখতে পারছে না ।
নিম্নে এ সকল সমস্যা দূরীকরণের প্রয়োজনীয় উপায় উল্লেখ করা হলো:
১. লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাস (Reduction of red tapism ) : লাল ফিতার দৌরাত্ম্য তথা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সমবায় সমিতির অগ্রসরতার জন্য কম-বেশি দায়ী। এক্ষেত্রে গতিশীলতা আনতে হলে সমবায় মন্ত্রণালয়, সমবায় বিভাগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অফিসে দক্ষ ও সমবায়ের মন্ত্রে আস্থাশীল কর্মঠ জনবল নিয়োগ করা যেতে পারে।
২. সমবায়মূলক শিক্ষার ব্যবস্থাকরণ (Arrangement of co-operative oriented education): সমবায় আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে দেশের সমবায়মূলক শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং পাঠ্যক্রমে এ বিষয়ক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করে সমবায় শিক্ষা জোরদার করা যেতে পারে ।
৩. সমবায় উন্নয়নে বৃহৎ পরিকল্পনা (Master plan for development of co- operatives): সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিবেচনায় রেখে একটি বৃহৎ বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারি উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত এ পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ।
৪. প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ (Adopting training programme): সমবায় সমিতির সাথে পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ সদস্যদের স্বল্পকালীন এবং কখনো বা দীর্ঘকালীন প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সংশ্লিষ্ট সকলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, কৃষিকাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব ধারণা অর্জনে সক্ষম হবে।
৫. দুর্নীতি ও স্বজন-প্রীতি রোধ ( Measures to prevent corruption and nepotism) : দুর্নীতি ও স্বজন-প্রীতি অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় সমবায়েও শক্তিশালী ভিত গড়েছে। এ ভিতকে উপড়ে ফেলতে হলে নিরপেক্ষভাবে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. সমবায়ের সুফল সম্পর্কিত প্রচারণা (Publicity regarding the merits of co- operatives): সমবায়ের কল্যাণমুখী ভূমিকা সম্পর্কে বেতার, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সাধারণ জনগণ সমবায় সম্পর্কে সচেতন হবে এবং এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠবে ।
৭. সাধারণ শিক্ষার সম্প্রসারণ (Expansion of general education): একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক খাত হিসেবে সমবায় আন্দোলন জাতীয়ভিত্তিক আন্দোলনের গুরুত্ব পাবার অবকাশ রাখে। এ কারণে দেশের জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা দরকার। দেশের দরিদ্র, অসচেতন সাধারণ লোকের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালাতে পারলে এ বিষয়ে ইতিবাচক ফল আশা করা যায় ।
৮. প্রণোদনার ব্যবস্থা (Taking incentive measures): এ সংগঠনের সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে সমবায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী, ব্যবস্থাপক এবং সদস্যদের বিশেষ পারদর্শিতার ভিত্তিতে প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নিরপেক্ষভাবে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৯. কার্যকর সমন্বয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ (Taking effective measures for co-ordination): প্রাথমিক, কেন্দ্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সমবায় সংগঠনসমূহের মধ্যে এবং সমবায়ের বিভিন্ন দপ্তর, সমবায় বিভাগ ও সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সমবায়ের উন্নয়নে একটি বড় অন্তরায়। এজন্য এসব ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও কার্যকর সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সমবায়ের বিকাশ ঘটাতে হবে ।
১০. সহজ শর্তে ঋণদান (Providing credit with simple terms & condition): মূলধনের স্বল্পতা সমবায় সমিতিগুলো সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। সমবায়ের সম্প্রসারণে সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে এ সমস্যা দূর করতে পারে ।
১১. সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি (Increasing government co-operation): এ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য বিষয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রণালয় কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
১২. গতিশীল তথ্য ব্যবস্থা (Dynamic information system): সমবায় সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হলে এ সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। এ কারণে বিভিন্ন প্রকার প্রকাশনা, মুদ্রণ ও তার যথাযথ বিতরণসহ সকল তথ্য প্রদানের ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও গতিশীল হতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে উপরিউক্ত ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভাগসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। সমবায়ের উৎপত্তি হওয়া বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে সরকার ও জনগণকে তাই একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
খাদিজা বেগম তার দিনমজুর এবং সম্পদহীন পিতামাতার একমাত্র কন্যা। সে তার বাবা-মার তৈরি মাটির ঘরে বড় হয়েছে। মাত্র ১১ বছর বয়সে একজন বেকার ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। আর বিবাহিত জীবন বোঝার আগেই তিনি দুসন্তানের জননী হন। জীবনের এ সময় এসে তিনি বুঝতে পারলেন তিনি তার স্বামী এবং দুসন্তান তার বাবা-মার সংসারে বোঝা স্বরূপ ঠিক এই সময় তিনি “নিজধারা মহিলা সমবায় সমিতি” নামে একটি সমবায় সমিতির নাম শুনলেন যেটি ছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে' (B.R) এর অধীন। পরে তিনি এ সমবায় সমিতির সদস্য হলেন। প্রথমে তিনি সমবায় সমিতি হতে ১০০০ টাকা ঋণ নিলেন এবং ঋণের ব্যবসা শুরু করলেন। ঋণ ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে যে মুনাফা হলো তা দিয়ে তিনি তার দৈনন্দিন খরচ মিটানোর পাশাপাশি ঋণের ১ম কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন। তারপর হতে উদ্দীপনার মাধ্যমে তার সংসার পরিচালনা করছেন। এভাবে তিনি ১৯৯২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোট ৬৮০০০ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন এবং দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী লালন-পালন করেন। তিনি দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী ক্রয় করে একটি ডেইরি ফার্ম এবং একটি পোলট্রি ফার্ম স্থাপন করেন। বর্তমানে তার খামারে আটটি গরু রয়েছে। এর মধ্যে ২টি বিদেশি গাভী এবং ৬টি মাঝারি সাইজের গাভী রয়েছে। বর্তমানে সে গাভী হতে প্রতিদিন ৩০ লিটার দুধ পায় যার বর্তমান বাজারমূল্য ৭৫০ টাকা। এ দিয়ে তিনি খামারের সব খরচ এবং তাদের দৈনন্দিন খরচ মিটানোর পর ৩০০ টাকা সঞ্চয় করেন। তিনি একটি পোলট্রি ফার্ম গড়ে তুলেছেন যেখানে ২০টি হাঁস এবং ৩২৫ টি মুরগি লালন পালন করেন। পোলট্রি ফার্ম হতে তিনি দৈনন্দিন চাহিদা মিটানোর পর অবশিষ্ট ডিম বাজারে বিক্রি করেন। তার মোট দৈনন্দিন জমা টাকা দিয়ে স্থানীয় ‘ধরা’ বাজারের নিকটে ২৬ শতাংশ জমি ক্রয় করেন যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩,০০,০০০ (তিন লাখ) টাকা। ‘ধরা’ বাজারে তিনি একটি কীটনাশক ঔষুধের দোকার দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি তার বাড়িতে একটি আধা পাকা ঘর দিয়েছেন। তার স্বামী বর্তমানে ট্রাক চালান । তার নিজের এবং তার স্বামীর আয়ে বর্তমানে তার সংসার খুব ভালোভাবে চলছে। এখন তিনি অনেক স্বচ্ছল। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছে। তার বৃদ্ধ বাবা-মার ও দেখাশুনা করছেন। বর্তমানে তিনি তার সমাজে এবং গ্রামে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি অন্য মহিলাদের জন্য অনুকরণীয়। বর্তমানে তিনি খুবই সুখী এবং এজন্য তিনি সমবায় সমিতির প্রতি কৃতজ্ঞ ।
আরও দেখুন...